১. নবজাতকের উদ্দেশ্যে দু’আ ও উপঢৌকন পাঠানো।
সন্তান ভূমিষ্ঠের পর নবজাতকের উদ্দেশ্যে তার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং উত্তম মানুষ হওয়া কামনা করে দু’আ করতে হবে। নবজাতকের জন্য উপহার উপঢৌকন দেওয়াও একটি উত্তম ব্যবস্থা। বস্তুত জন্মের সুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার অধিকার প্রত্যেক শিশুরই রয়েছে। অর্থাৎ কারাে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার উচিত আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীদের সেই সংবাদ প্রদান করা এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের উচিত যার সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাকে অভিনন্দন জানান ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।
এ প্রসঙ্গে নিমােক্ত আয়াত প্রণিধানযােগ্য-. “আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদ নিয়ে ইবরাহীমের কাছে এলাে। তারা বলল : সালাম, সেও বলল, সালাম । সে অবিলম্বে এক কাবাব করা গাে-বৎস আনল । সে যখন দেখল তাদের হাত সেগুলাের দিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করল এবং তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতির সঞ্চার হলাে। তারা বলল, ভয় করাে না, আমরা নূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি । তখন তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে রইল এবং সে হাসল । অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম।”(আল কুরআন, সূরা হূদ-১১ : ৬৯-৭১)
“হে যাকারিয়া! আমি তােমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এক পুত্র সন্তানের, যার নাম হবে ইয়াহইয়া, ইতঃপূর্বে আর কাউকেও এ নামধারী করিনি।” — (আল-কুরআন, সূরা মারইয়াম ১৯ : ৭)
২. উত্তমরূপে গােসল করিয়ে পাক-পবিত্র করা
শিশু জন্মের পরপরই তাকে উত্তমরূপে গােসল এবং শরীরে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। নাভী কাটা থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
শীতকালে গােসল করানাের সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেন তাকে ঠাণ্ডায় আক্রমণ করতে না পারে। গােসলের সময় যাতে নাক, কান ও মুখে পানি প্রবেশ করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। গােসলের পরপরই শরীর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে এবং আবহাওয়া অনুযায়ী নরম কাপড়-চোপড় পরাতে হবে ।
নবজাতক বেশি আলােকোজ্জ্বল স্থানে রাখা যাবে না। এতে শিশুর চোখের জ্যোতি হ্রাস পেতে পারে। শিশুকে এক পাশে বেশিক্ষণ শুইয়ে রাখা বা কোনাে একদিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকতে দেওয়া যাবে না। শিশুকে একা ঘরে রেখে কোথাও যাওয়া ঠিক
হবে না। এতে অবাঞ্চিত কোনাে ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে ।
৩. ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেয়া
শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত ধ্বনি শােনান কর্তব্য। অর্থাৎ আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। হাদীসে এসেছে,“হযরত উবায়দুল্লাহ ইবনে আবু রাফে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হযরত ফাতিমা রা. যখন ইমাম হাসান রা. কে প্রসব করলেন তখন “রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কানে সালাতের আযানের মতাে আযান দেন।”(ইমাম তিরমিযী, হাদীস নং ১৫১৪)
ইমাম বাইহাকী ও ইবনে আনাসী রহ. হযরত হুসাইন ইবনে আলী রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সা, ঘােষণা করেছেন “কোনাে ব্যক্তির যখন শিশুসন্তান জন্মগ্রহণ করে তখন যদি তার ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত ধ্বনি শােনানাে হয় তবে সে শিশুর বিশেষ ধরনের রােগ তথা জিনের প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পায়।”–( আবু বকর আহমদ বিন আল হুসাইন আল বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং : ৮২৫৪)
৪. তালকীন’ দেওয়া :জন্মের পরপরই সন্তানকে ইসলামি কালিমা শুনানাে
জন্মের পর পরপরই সন্তানকে ইসলামি কালিমা শুনানাে অর্থাৎ আযান ও ইকামত শােনানাের মাধ্যমে সন্তানকে পৃথিবীর আলােয় আসার সাথে সাথেই তার কর্ণকুহরে আল্লাহ তা’আলার প্রভুত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের বাণী এবং কালিমায়ে শাহাদাতের বাণী শুনিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসার আহ্বান জানানাে । এ যেন ইসলাম গ্রহণের ‘তালকীন’ দেওয়ার মহড়া যেমন মুমূর্য ব্যক্তির মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তার কানে কালিমায় তাওহীদের ‘তালকীন’ দেওয়া হয়।-(ইবনুল কাইয়্যিম, তুহফাতুল মাওলুদ, কয়রাে, মাকতাব ওবাইদুল্লাহ কুর্দী, তাবি, পৃ ৫৬৭)
আযান ও ইক্বামতের বাণী শােনানাের উপকার হচ্ছে এতে শয়তান দূরে সরে যায়। তাছাড়া এর মাধ্যমে নবজাতকের ইসলামের আহ্বান প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আমন্ত্রণ জানানাে হয় । কেননা, ইসলামের স্বভাব ধর্মেই তার জন্ম এবং দুনিয়ার জীবন তাকে এ ইসলামেরই আলােকে পরিচালিত করতে হবে। এভাবে নবজাতককে প্রথম হতেই ইসলামের শাশ্বত জীবনবােধ, প্রত্যয় ও আকীদার ওপরে প্রতিষ্ঠা করা এবং শয়তান ও অন্যান্য মতবাদের বেড়াজাল থেকে বের করে খাঁটি আল্লাহর বান্দা হওয়ার আহ্বান করা হয়।( ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, প্রাগুক্ত, খণ্ড-৩, পৃ. ১৬৮৯, হাদীস নং ২১৪৪)
৫. তাহনীক করার মাধ্যমে মুখের জড়তা দূর করা
নবজাতক শিশু ভূমিষ্ঠ হলে ইসলামি শরী’আয় যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে তাহনীক করা অন্যতম। তাহনীক মানে হচ্ছে পাকা খেজুর চিবিয়ে তার মিষ্টি রস আঙ্গুলের মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে শিশুর মুখে দেওয়া ।
যদি খেজুর না পাওয়া যায় তবে মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য যেমন : মিছরি, চিনি, শিরা, কিংবা মধু দেওয়া যায়। এতে নবী করীমের সুন্নাত পালন করা হয়। এর ফলে শিশুর বন্ধ মুখ খুলে যাবে এবং শিশুর মুখের নড়াচড়ার মাধ্যমে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে । কিছু পেটে গিয়ে শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে ।
৬. মাথা মুণ্ডন করে চুলসম দান করা
নবজাতক শিশুর জন্মের পর সপ্তম দিনে মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নাত । পিতা- মাতা সামর্থ্যবান হলে শিশুর মুণ্ডিত চুলের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য গরিব-দুঃখীদের মাঝে সাদাকাহ করে দেওয়া মুস্তাহাব।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের বাণী, “হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. হাসান রা.-এর পক্ষে বকরি দ্বারা আকিকা করলেন এবং স্বীয় কন্যা ফাতিমাকে নির্দেশ দিলেন মাথা মুণ্ডন করতে এবং মাথার চুল সমপরিমাণ ওজনে রৌপ্য দান করতে।”( ইমাম তিরমিযী, জামিউত তিরমিযী, হাদীস নং : ১৫১২৯)
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশুর চুল মুণ্ডন করলে তার স্বাস্থ্য ভালাে থাকে, শক্তিশালী হওয়ার সুযােগ পায় এবং মাথার গঠন সুষম হয়। এর ফলে। শিশুর দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ শক্তির ভারসাম্য রক্ষিত হয়। তবে শিশুর মাথার চুল কিছু অংশ কাটা ও কিছু অংশ রাখা কিংবা মাঝখান থেকে কাটা বা চারদিক দিয়ে কাটা এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে।” (ইবনে কইয়্যিম, তুহফাতুল মাওলুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬৮)
শিশুর এ মাথা মুণ্ডনের কাজটি আকীকার পূর্বেই করতে হবে । হাদীস শরীফে নবজাতকের মাথার চুলকে তার জন্য কষ্টদায়ক বস্তুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই তা ফেলে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আকীকার পশুর রক্ত দ্বারা নবজাতকের মুণ্ডিত মস্তক রঞ্জিত করে নেওয়ার প্রথাকে রাসূল সা. অপছন্দ এবং নিষিদ্ধ করেন। অবশ্য রক্ত রঞ্জিত করার পরিবর্তে মস্তকে জাফরান প্রভৃতি সুগন্ধি মাখা সুন্নাত।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যখন হযরত হাসান ইবন আলী ভূমিষ্ঠ হন তখন রাসূলুল্লাহ সা. তার ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দিয়েছিলেন। হযরত আবু রাফে রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখেছি, তিনি হাসান ইবনে আলী রা.-এর কানে আযান দিয়েছিলেন যখন হাসান রা. হযরত ফাতিমা রা.-এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।-(১৮ ইসলামী আইন বিধিবদ্ধকরণ বাের্ড, প্রাগুক্ত, ধারা-১২০১, পৃ ৮৩৫।)
৭. শিশুর সুস্থ শারীরিক বিকাশের লক্ষ্যে দুধ খাওয়ানাে
করুণাময় আল্লাহ তা’আলা মানব শিশু সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার লালন-পালনের যাবতীয় ব্যবস্থা তিনিই করেন । নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের বুকে দুধ সৃষ্টি করে রাখেন যা হালকা মিষ্টি ও উষ্ণ । যা নবজাতক শিশুর নাজুক অবস্থার উপযােগী। তাই শাল দুধ শিশুকে খাওয়াতে হবে। এতে শিশুর মধ্যে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা ও শরীর গঠনের প্রচুর উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। -(* মাওলানা আমীনুল ইসলাম, তাফসীরু নূরুল কুরআন, খণ্ড-২, ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯০, )
মায়ের দুধপানের মাধ্যমে মা-শিশুর অকৃত্রিম বন্ধন তৈরি হয়। মায়ের সঙ্গে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক সংযােগ সৃষ্টি হয় এবং শিশুর চরিত্র গঠনেও এর প্রভাব বিশেষভাবে সহায়ক। তাই শিশুকে শালদুধসহ বুকের দুধ পান করানাে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে শালদুধ দেওয়া উচিত। দুধপান সম্পর্কে কুরআনের বাণী, “আমি তাে মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি, তার মাতাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে, এর পর তার দুধ ছাড়ানাে হয় দুই বছরে।”(আল-কুরআন, সূরা লুকমান ৩১: ১৪।)
অন্য আয়াতে ঘােষিত হয়েছে- “আমি মূসার মাকে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলাম, তাকে দুধপান করাও।”( আল-কুরআন, সূরা আল কাসাস ২৮ : ৭)
৮.নাম রাখা
শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে নাম রাখা সুন্নাত । হাদীসের বাণী- “হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, প্রত্যেক নবজাত শিশু তার আকীকার নিকট বন্দি, তার জন্মের ৭ম দিবসে তার নামে পশু জবাই করতে হবে, তার নাম রাখতে হবে এবং তার মাথার চুল মুণ্ডন করতে। (ইমাম ইবনে মাজাহ, সুনান ইবনি মাজাহ, হাদীস নং ৩১৬৫)
৯. আকীকা করা
নবজাতক শিশুর ইসলামসম্মত নাম রাখার পর পিতা-মাতার কর্তব্য হলাে আকীকা করা । আকীকা বলা হয় পুত্রসন্তানের জন্য দুটি আর মেয়েসন্তানের জন্য একটি পশু কুরবানি করা । আকীকার দ্বারা সন্তানের ওপর থেকে বালা-মুসিবত দূর হয়ে যায় । দানশীলতার বিকাশ ঘটে। গরিব-মিসকীন আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর হক আদায় হয়। সামাজিক বন্ধন, পরস্পর হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা করা সুন্নাত ।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- “সালমান ইবনে ওমর আদদ্ববিঈ রা. বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি, শিশু জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে আকীকা করা কর্তব্য এর মাধ্যমে রক্ত ঝরাও আর সে শিশু থেকে পঙ্কিলতা দূর কর।”( ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫১৫৪)
সামুরা ইবন জুনদুব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ আলাইহি ঘােষণা করেন যে, “নবজাতক শিশু নিজ আকীকার সাথে বন্ধক থাকে, তার জন্মের সপ্তম দিন তার নামে একটি আকীকার পশু যবেহ করবে।”(ইমাম তিরমিযী, জামিউত তিরমিযী, হাদীস নং ১৫২২)
হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে আদেশ করেছেন- “আমরা যেন ছেলে-সন্তানের জন্য দুটো ছাগল আর মেয়েসন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকা করি।”( ইবন মাজাহ, সুনান ইবনি মাজাহ, হাদীস নং ৩১৬২।)
সামর্থ্যবান হলে এবং সম্ভব হলে শিশুর জন্মের সপ্তম দিবসে আকীকা করা উত্তম। শিশুর জন্ম ও তার আকীকার মাঝে সময়ের একটু ব্যবধান হওয়া
দরকার । কেননা নতুন শিশুর জন্ম লাভের ব্যাপারে ঘরের সকলের জন্যই বিশেষ ব্যস্ততার কারণ হয়ে থাকে। এ থেকে অবসর হওয়ার পরই আকীকার প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে । আকীকা সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে চতুর্দশতম বা একবিংশতম দিবসে করা যেতে পারে । তাও সম্ভব না হলে যে কোনাে দিন সম্ভব হয় করা যাবে।-(মুস্তাদরাকে হাকিম, বৈরুত, দারুল কিতাবু আল আরাবী, খণ্ড-৪, পৃ. ২৩৯।)
১০. কালিমা শিখানাে
শিশু যখন কথা বলতে শেখে তখন তাকে সর্বপ্রথম কালিমায়ে তাইয়্যিবা শিক্ষা দেবে । যার প্রভাব তার সমগ্র জীবনে প্রতিফলিত হওয়ার আশা করা যায় । তাছাড়া জীবনের উষালগ্নেই শিশুকে নিজ সৃষ্টিকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং সেই সৃষ্টিকর্তা যে শরীকহীন, তাঁর কোনাে অংশীদার নেই, তিনি একক ও অদ্বিতীয় এ পরিচয় দিয়ে দেওয়া প্রত্যেক পিতামাতা ও অভিভাবকের নৈতিক দায়িত্ব।
এ বিষয়ে মহানবী (সা.)বলেন- “তােমরা নিজ নিজ শিশুকে সর্বপ্রথম কথা শেখাবে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”-(বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং : ৮২৮২।)
১১, খাতনা করানাে।
শিশুর আরও একটি অধিকার হলাে শৈশবের প্রারম্ভেই সুন্নাতে খাতনা করানাে। এটা পিতা-মাতার ওপর সন্তানের হক। খাতনা সকল নবী-রাসূল আ.-এর সুন্নাত এবং ইসলামের প্রতীক।
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রলেন “পাঁচটি কাজ সুন্দর স্বভাবের মধ্যে গণ্য খাতনা করা, নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করা, বগলের চুল উঠানাে, মােচ কাটা এবং নখ কাটা।” (ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, কিতাবুল এসতি’যান, খণ্ড-৫, পৃ. ২২০৯, হাদীস নং ৫৫৫২।)
খাতনার সময় : সপ্তম দিন খাতনা করানাে সুন্নত। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান এবং হুসাইনের সপ্তম দিন আকিকা দিয়েছেন ও খাতনা করিয়েছেন। মূলত খাতনার বয়স জন্মের এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয়, তবে সাত বছর পুরাে হওয়ার আগেই তা সেরে নেয়া ভালাে, সাবালক হওয়ার পূর্বে খাতনা করা অবশ্য জরুরি।
ডাক্তারি বিদ্যা প্রমাণ করেছে যে, জন্মের এক সপ্তাহ পর থেকে তিন বৎসরের মধ্যে খাতনা সম্পাদন করা উত্তম। খাতনার বিধানের ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, খাতনা সুন্নত। ইমাম শ্যাফিঈ, মালেক ও আহমদ রাহিমাহুমুল্লাহ বলেন, খাতনা ওয়াজিব।
এ ব্যাপারে ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আরাে কঠোর অবস্থান নিয়ে বলেছেন, যে খাতনা করবে না তার ইমামতি ও সাক্ষ্য গ্রহণযােগ্য নয়। কাজি আয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, অধিকাংশ আলেমের নিকট খাতনা সুন্নত, এ সুন্নত পরিত্যাগ করা গােনাহ ।
১২. শিশুসন্তানকে ভালােবাসা
শিশুসন্তানের প্রতি পিতামাতার অকৃত্রিম ভালােবাসা আল্লাহ প্রদত্ত এবং সহজাত এতে কোনাে সন্দেহ নেই । আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মাতা-পিতার অন্তরেই সন্তানের প্রতি ভালােবাসা সৃষ্টি করেছেন ।
মাতা-পিতা মুসলিম হােক বা না হােক, কোনাে ধর্ম বা আল্লাহতে বিশ্বাসী হােক বা না হােক তাতে কোনাে তারতম্য নেই। কেননা, শিশুসন্তান হলাে মাতা-পিতার এক উষ্ণ মিলনের ফলশ্রুতি। পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব দুটো মহৎ অর্থ বিশেষ ।
যার মধ্যে আল্লাহ গচ্ছিত রেখেছেন। তাঁর করুণা ও ভালােবাসার কিছু নিদর্শন। তিনি পিতা-মাতার ওপর বর্ষণ করেছেন আপন দয়া ও কল্যাণের বারিধারা, যার কারণে তারা প্রাপ্ত হন পারস্পরিক সুসম্পর্ক এবং ধারাবাহিকতার অনুভূতি।
কুরআন বলছে-“আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনসমূহের মধ্যে এও একটি যে, তিনি তােমাদের হতে সৃষ্টি করেছেন তােমাদের জুড়ি যাতে তােমরা তার নিকট গিয়ে প্রশান্তি পেতে পার, আর তােমাদের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভালােবাসা ও করুণার সম্পর্ক।”( আল-কুরআন, সূরা আর রুম ৩০ঃ ২১)
কোনাে কোনাে তাফসীরকার আয়াতে উল্লিখিত ভালােবাসা ও করুণার দ্বারা সন্তান-সন্ততির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কেননা, এর মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক মজবুত হয় এবং এ সম্পর্কের মধ্যে স্থিতিশীলতা আসে । মূলত স্বামী-স্ত্রীর আবেগ উচ্ছাসপূর্ণ প্রেম-ভালােবাসা পরিণতি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে এ সন্তানের মাধ্যমে ।
সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য-জীবনের নিষ্কলুষ পুষ্পবিশেষ। তাই সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার ভালােবাসা অকৃত্রিম ও নিখাদ ও স্বভাবজাত । সন্তানের ভালােমন্দ সম্পর্কে পিতা-মাতা সর্বাধিক সচেতন হয়ে থাকেন। সন্তানের প্রতি তাদের যদি এ অকৃত্রিম ভালােবাসা না থাকত তাহলে বিশ্ব চরাচরে মানব অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য নিঃশেষ হয়ে যেত । সন্তান-সন্ততি মাতাপিতার জন্য অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ অলঙ্কার এবং মানব সম্পদ বিকশিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম । সৎ সন্তান মাতাপিতার জন্য আশীর্বাদ ও আল্লাহর বিশেষ রহমত ।
কুরআনে এসেছে-
“ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শােভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম । তােমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট |”(আল-কুরআন,সূরা আল কাহাফ ১৮ঃ৪৬)
ছােটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করার নির্দেশ ও বড়দের দেখানাের নির্দেশ সম্মান দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- “সে আমার দলভুক্ত নয়, যে ছােটদের প্রতি স্বেহপরায়ণ ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় ।”-(ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াস্ সিলাহ, বাবু মা জা’আ ফি রহমাতিস্ সিবইয়ান,
খন্ড ৪ পৃ.৩২১)
এছাড়া সনেহ ভালোবাসা পাওয়া শিশুদের অধিকার ( বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত, ধারা- ১৩০৫, পৃ ৮৪০,।)
“হযরত ‘আয়িশা রা, বলেন, “জনৈক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সা.-এর খিদমতে এসে বলল, আপনি কি শিশুদের চুমু দেন? আমরা তা কখনো শিগুদের চুমু দেই না। রাসূলুল্লাহ সা. তাকে বললেন, আল্লাহ যদি তােমাদের অন্তর থেকে দয়া মহব্বত ছিনিয়ে নিয়ে থাকেন, তবে আমারই বা কি কুরার আছে?”(ইমাম বুখারী, সহীহ আল বুখারী, হাদীস নং ৫৯৯৮)
১৩. সন্তানকে সঠিক লালন-পালন।
শিশু-সন্তান জন্ম গ্রহণের পর প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । হৃদয় নিংড়ানো ঐকান্তিক ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার কোমল পরশে শিশুকে অতি যত্নসহকারে প্রতিপালন করা কর্তব্য।
পিতামাতার উচিত সন্তানদের প্রতিটি বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করা, তাদের জন্য উপযুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা এবং তাদের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ করা।
কুরআনে এসেছে- “সন্তান ও জননীর ভরণ-পােষণের ভার পিতার ওপরই ন্যস্ত ।”আল-কুরআন, সূরা আল বাকৃারা ২৪ ২৩৩।
পিতার নিকট সন্তানের অধিকার হচ্ছে তিনি তাদের তার খানাপিনা, থাকা ও পােশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করা । বিশেষ করে যতদিন সে নিজস্ব ক্ষমতায় উপার্জন করতে সমর্থ না হয়। আর এটা না করলে পিতা ওনাহগার হবে।
মহানবী বলেন-
“যাদের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব কারাে ওপর ন্যস্ত থাকে, সে যদি তা যথাযথভাবে পালন না করে তাদের ধবংস করে, তা হলে এতেই
তার বড় গুনাহ হবে ”
বস্তুত জন্ম হওয়ার পর থেকে সে উপার্জনক্ষম হওয়া পর্যন্ত তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা পিতার দায়িত্ব। এ হলোা সন্তানের অধিকার।
প্রত্যেক পিতাকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সস্তানের ব্যয়ভার বহন করতে হবে। আইনের মাধ্যমে এ কাজ তাে বেশ কঠিনই হতোে, যদি না আল্লাহ তা’আলা পিতার অন্তর সন্তানের জন্য খরচ করার আবেগ সৃষ্টি করে দিতেন।
তাই দেখা যায়, পিতা কঠাোর পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে আয়-উপার্জন করেন তা ছ্বিধাহীন চিত্তে সম্তানের জন্য খরচ করে থাকন এবং সন্তানের হাসিমুখ দেখে প্রশান্তরচিত্ত তা মেনে নেন। তাছাড়া পিতামাতা সব সময় শিশুসন্তানের কল্যাণে সবকিছু করবে, সন্তানের কল্যাণকামী হবে, তাদের সৎ্পথে চালাবে। তাদের জন্য দু’আ করবে।
আল-কুরআনের বাণী, “হে প্রতভু! তুমি আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী বানাও। প্রভু আমার, তুমি প্রার্থনা কবুল কর।”(আল-কুরআন, সূরা ইবরাহীম ১৪ :8০)
১৪. নামাযের আদেশ করা এবং বিছানা আলাদা করে দেওয়া
সন্তানকে বাল্যকাল থেকেই ইসলামি অনুশাসন শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাত বছর বয়সে নামাযের আদেশ এবং দশ বছর বয়সে বছানা আলাদা করে দেয়া পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস, “হযরত ওমর ইবনে শুআইব তার পিতা, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা, বলেন, তােমরা তামাদের সন্তানদেরকে সাত বছরে উপনীত হলে নামাযের আদেশ দাও। আর যখন তারা দশ বছরে উপনীত হয়, তখন তাদেরকে (নামায না পড়লে) প্রহার কর এবং বিছানা আলাদা করে দাও (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং : ৪৯৫)
১৫, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা
সন্তান জন্মের পর পরিণত বয়সে মাতা-পিতার ওপর কর্তব্য হলাে সন্তানকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সন্তান জন্মের সাথে সাথেই মা-বাবার প্রতি
প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব কর্তব্য পালন করতে হয় সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা,-এর একটি হাদীস থেকে জানা যায় যে- “হযরত আবু রাফি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ সা, কে জিজ্ঞেস করলেন যে, সন্তানদের প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য আছে কিনা, যেমনিভাবে আমাদের ওপর তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে?
উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা, বললেন- হ্যা, আর তাহলো কিতাব শিক্ষা দেওয়া, সাঁতার শিখানাে, ধনুক প্রশিক্ষণ ও যথাযথভাবে সম্পদের অংশীদার বানানো।”–( ইমাম অল বায়হাকী, সুনান আল বায়হাকী আল কুবরা, হাদীস নং ১৯৭৪২)
“পিতামাতার প্রতি সন্তানের অধিকার প্রধানত তিনটি- জন্মের পরই তার জন্য উত্তম নাম রাখতে হব, জ্ঞান বৃদ্ধি হলে তাক কুরআন শিক্ষা দিতে হবে।
আর সে যখন পূৃর্ণবয়স্ক হবে, তথন তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে ইসলামে নামের বিধি-বিধান নামকরণ শব্দটি ‘নাম ধাতু থেকে উতদ্ভুত। বাংলায় নাম বলতে আখ্যায়, অভিধা, সংজ্ঞা, যে শব্দ দ্বারা কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্ধারণ করা যায় ইত্যাদি “–(বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং : ৮২৯৯।)