রোলস রয়েলস বৈদ্যুতিক বিমান তৈরি সম্পর্কে আজ আপনাদের সাথে আলোচনা করবো। পুরো আর্টিকেল টি পড়ুন
ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রোলস-রয়েস সম্প্রতি স্পিরিট অব ইনোভেশন নামে একটি বৈদ্যুতিক বিমান তৈরি করেছে যা গতির ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পরীক্ষামূলক উড়ানের সময় বিমানটির সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৬২৩ কিলোমিটার।
সম্পূর্ণ ব্যাটারি-চালিত এই বিমানের দ্রুত গতিতে সফল উড্ডয়নের পর ইলেকট্রিক এভিয়েশন নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা শুরু হয়েছে যা আগামী দিনের ইলেকট্রিক যাত্রীবাহী বিমান তৈরী করতে উৎসাহ দিবে।
বর্তমানে যেসব বিমান চলাচল করে সেগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় যার ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ ঘটে। এর ফলে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার একজন বিজ্ঞানী ড. তানভীর ফারুক – যিনি বিমান উড্ডয়নের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছেন – তিনি বলছেন।
স্পিরিট অব ইনোভেশন প্রমাণ করেছে যে বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে একটি বিমান ওড়ানো সম্ভব। এবং ব্যাটারি-চালিত একটি বিমান যে যাত্রীবাহী হওয়া সম্ভব সেই সম্ভাবনাও তৈরি করেছে এই বিমানটি।
ইলেকট্রিক বিমান কতোটা দ্রুত গতিতে উড়বে
এই প্রশ্নের জবাবে ড. ফারুক বলেন – তা নিয়ে এখনও সংশয় রয়ে গেছে। এটা প্রপেলার-চালিত বিমান। এধরনের বিমানের একটা নির্দিষ্ট গতি-সীমা থাকে। প্রপেলার-চালিত বিমান দিয়ে আমি কখনোই শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে উড়তে পারবো না।
ড. ফারুক আরও বলেন বর্তমানে যেসব বিমান চলাচল করে, যেমন বোয়িং বা এয়ারবাস, এগুলো সব টার্বো ফ্যান বা টার্বো জেট বিমান। এই প্রযুক্তিতে দ্রুত গতির বাতাসকে টেনে নিয়ে ওই বাতাস দ্রুত গতিতে বিমানের পেছন দিকে ইঞ্জিনের এগজস্ট দিয়ে বের করে দেওয়া হয় যার ফলে বিমানটি দ্রুত গতিতে উড়তে পারে।
কিন্তু প্রপেলার-চালিত প্রযুক্তি ভিন্ন উপায়ে কাজ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব যাত্রীবাহী অথবা যুদ্ধবিমান ছিল, তার সবই ছিল প্রপেলার-চালিত।
প্রপেলার ঘূর্ণনের জন্যই বিমানটি সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এ কারণে এর একটি সীমাবদ্ধতা থেকেই যায় যে এটি কতো দ্রুত গতিতে যেতে পারবে এবং তাদের কতোটা ধারণ ক্ষমতা থাকবে।
দ্রুত গতির বৈদ্যুতিক বিমান কিভাবে বানানো হল
রোলস-রয়েসের বলছে তাদের স্পিরিট অব ইনোভেশন বিমানটি তিন কিলোমিটারেরও বেশি পথ উড়েছে ঘণ্টায় ৫৫৬ কিলোমিটার গতিতে এবং ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে ঘণ্টায় ৫৩২ কিলোমিটার স্পিডে।
এর আগে দ্রুতগতিতে ইলেকট্রিক বিমান উড্ডয়নের যে রেকর্ড ছিল সেটি করেছিল সিমেন্সের ই-এয়ারক্রাফট বিমান, ২০১৭ সালে। তবে সেটি পুরোপুরি বৈদ্যুতিক বিমান ছিল না – ছিল হাইব্রিড বিমান। অর্থাৎ কিছুটা জীবাশ্ম জ্বালানি ও কিছুটা ব্যাটারি দিয়ে চালিত।
এখন রোলস-রয়েস এর এই বিমানটি সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক এবং তার গতি ছিল সিমেন্সের বিমানের তুলনায় ২১৩ কিলোমিটার বেশি। যা ছিল এক কল্পনা বাস্তবে রূপ পাওয়া।
অধ্যাপক ড. তানভীর ফারুক বলেন, “জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বর্তমানের বিমানগুলো এরচেয়েও দ্রুতগতিতে উড্ডয়ন করতে সক্ষম। বিমানের গতি হিসাব করা হয় মাক নম্বর দিয়ে। কোনো বিমান শব্দের গতির চেয়ে কত দ্রুত বা ধীর গতিতে যাচ্ছে তার মান নির্ণয়ের নম্বর এই মাক।”
স্পিরিট অব ইনোভেশনের সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে মাক ০.৫। তার মানে এটি শব্দের গতির অর্ধেক বেগে যেতে পারছে। কিন্তু আধুনিক ড্রিমলাইনার বোয়িং-৭৮৭ এর গতি মাক ০.৬ থেকে মাখ ০.৭৫ পর্যন্ত। তার মানে এসব প্রচলিত বিমান স্পিরিট অব ইনোভেশনের চেয়েও দ্রুত গতিতে উড়তে পারে।
স্পিরিট অব ইনোভেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে যে এটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ-চালিত ব্যবস্থায় চলে। এই বিমানে যে প্রপেলার চালানো হচ্ছে সেটা পুরোপুরি ব্যাটারির শক্তি দিয়ে চলে।
বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিমানটির এতো দ্রুত উড়ল কীভাবে?
প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্যাটারি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গত চার পাঁচ বছরে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এর শক্তি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিমান তারই একটি উদাহরণ।
ব্যাটারির শক্তি বেশি হওয়ার কারণে এটি প্রপেলারকে আরো দ্রুতগতিতে ঘুরাতে পারে। একটি বিমান কতো দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হবে সেটি নির্ভর করে প্রপেলারটি কতো দ্রুত ঘুরছে তার উপর।
শক্তিশালী ব্যাটারি ব্যবহার
স্পিরিট অব ইনোভেশন বিমানটিতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে তার শক্তি ৪০০ কিলোওয়াট অর্থাৎ একটি ৫৩৫ ব্রেক হর্স পাওয়ার বা বিএইচপি সুপারকারের সমান।
এর অর্থ হচ্ছে, এই বিমানটি এতো জোরে চলে যে তাকে থামাতে হলে ৫৩৫টি ঘোড়া দিয়ে এটিকে পেছনে টানতে হবে। রোলস-রয়েস বলছে তাদের এই ব্যাটারিতে যে শক্তি আছে তা দিয়ে সাড়ে সাত হাজার ফোন চার্জ করা সম্ভব।
যাত্রী নিয়ে বিমানটি কি উড়ানো সম্ভব
স্পিরিট অব ইনোভেশনের পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময় তাতে পাইলট ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। কিন্তু সাধারণ বিমানের মতো কয়েকশ’ যাত্রী নিয়ে একটি ব্যাটারি-চালিত বিমানের পক্ষে কি এতো দ্রুতগতিতে উড়ে যাওয়া সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি বিমান কতো দ্রুতগতিতে উড়বে সেটা নির্ভর করে তার পে-লোডের ওপর। পে-লোড হচ্ছে বিমানের ওজন ধারণ ক্ষমতা।
স্পিরিট অব ইনোভেশনের যে ওজন তার একটি বিশাল অংশ তার ব্যাটারির ওজন। কিন্তু একটি সাধারণ বিমান জ্বালানি পোড়ানোর কারণে এটি যতই অগ্রসর হয় ততই এর ওজন কমতে থাকে। কিন্তু ব্যাটারি-চালিত এই বিমানটির ক্ষেত্রে যাত্রাপথে তার ওজনের কোন তারতম্য ঘটবে না। এর ফলে ডেড-ওয়েইট হবে অনেক। কারণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে এই ব্যাটারি বহন করতে হবে।
কতো দূর ও কতো উঁচুতে উড়তে পারবে
একই সাথে ব্যাটারি-চালিত বিমান দিয়ে বেশি দূরের পথ পাড়ি দেওয়াও সম্ভব নয়। এখনও পর্যন্ত ব্যাটারির যে প্রযুক্তি তাতে দীর্ঘ সময় ধরে উড্ডয়ন করার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। স্পিরিট অব ইনোভেশন ১০/১৫/১৮ মিনিট সময় ধরে উড়তে পারে।
রোলস-রয়েসের এই বিমান শুধু যে গতির ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড করেছে তা নয়। রেকর্ড তৈরি হয়েছে উঁচুতে উড্ডয়নের ক্ষেত্রেও। তিন হাজার মিটার উচ্চতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে যে রেকর্ড ছিল, তাও ভেঙেছে স্পিরিট অব ইনোভেশন বিমানটি।
উপরে উঠলে বিমানের কিছু সুবিধা আছে। যতোই উপরে উঠবে বাতাসের ঘনত্ব ততই কমে যাবে। বাতাসের ঘনত্ব কমা মানে ঘর্ষণের কারণে যে গতি ধীর হয়ে আসে সেই অ্যারো-ডাইনামিক ড্র্যাগ কমে যাবে। এর ফলে বিমানটি দ্রুতগতিতে এবং বেশিক্ষণ ধরে উড়তেও পারবে।
কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের ক্ষেত্রে বিদ্যুতিক বিমানের ভূমিকা?
রোলস-রয়েসের প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন ইস্ট বলেন, উড়োজাহাজের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে স্পিরিট অব ইনোভেশনের এই ইঞ্জিন সাহায্য করবে।
স্পিরিট অব ইনোভেশন সম্পর্কে মন্তব্য
প্রথমত দেখতে হবে ব্যাটারি-চালিত এই বিমানটি কতজন যাত্রী নিয়ে উড্ডয়ন করতে পারবে। যদি বিমানটি একজন যাত্রী বহন করতে পারে সেক্ষেত্রে তেমন একটা সুবিধা পাওয়া যাবে না। কারণ ১০০ জন যাত্রী পরিবহনের জন্য ১০০টি বৈদ্যুতিক বিমানের প্রয়োজন হবে।”
দ্বিতীয়ত আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এসব ব্যাটারি যে আমরা চার্জ করবো সেই চার্জ কোথা থেকে আসছে। আমি যদি জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়েই আমার ব্যাটারি চার্জ করি তাহলে তো তেমন লাভ হচ্ছে না।
তৃতীয়ত এটা ভুল ধারণা যে ইলেকট্রিক হলেই কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে। কিন্তু ইলেকট্রিক করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি কতোটুকু জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি তার ওপরেই নেট এমিশন বা মোট নির্গমন নির্ভর করছে।