আমাদের মধ্যে অনেকে কালো জাদু বিষয়ে কোন ধারনা  নেই। কারো ধারনা থাকলে তা বিশ্বাস করেন না। আর তাই আমরা কালো জাদুর গল্প টি আপনাদের কাছে শেয়ার করছি। আশা করি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। কালো জাদুর গল্প ঘটেছিল আরাফাত নামক এক ভায়ের সাথে।

[কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :১]

কালো জাদু সম্পর্কে আরাফাতের ধারণা অত্যন্ত ধোঁয়াটে ছিল। সে কালো জাদু বা ঝাড়ফুঁক কোনোটাতেই বিশ্বাস করত না। এসব তো দূরের কথা, অতিলৌকিক কোন কিছুতেই আরাফাত একদম বিশ্বাস করত না। এমনকি ধর্মেও না। যদিও ধর্ম সম্পর্কে তার ধারণা গুলো সে কখনো মুখ থেকে উচ্চারণ করেনি, কিন্তু মন থেকে সে নিজেকে অজ্ঞানবাদীদের উর্ধ্বে নাস্তিকদের তালিকায়ই ফেলতো। পেশায় আরাফাত একজন ব্যবসায়ী। অত্যন্ত ধনী। সেকেন্ডক্লাস ট্রেনে সে বাড়ি ফেরে শুধু অতীতের স্মৃতিচারনের উদ্দেশ্য। এবারও তাই করছে। ২ সপ্তাহ খানেকের ছুটি। ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত। ট্রেনের বগিতে বসে আরাফাত চা খাচ্ছে আর ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করছে। এখনও তার সামনের সিটে কেউ বসে নি। তার আশা ছিলো কোন এক সফর সঙ্গী মিলবে যার সাথে বসে লম্বা ৮-৯ ঘন্টার জার্নিটাকে আরামসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু তার আশায় গুড়ে বালি দিয়ে ঝাকড়া চুলের পাগলাটে লোক এসে বসলো তার সামনের সিটে। কালো জুব্বা পরা, গলায় এক রাশ তাবিজ আর পুতির মালা, আর হাতে একটা মরচে ধরা ট্রাংক। বয়স ষাটোর্ধ্ব হবে। এমন উদ্ভট সহযাত্রী কে দেখে আরাফাত বুঝে ফেলল, সফরটা তার বোবা হয়েই কাটাতে হবে। লোকটাকে দেখেও মনে হচ্ছিলো সে আরাফাতের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। তাই দুই দিকেই সাইলেন্স। প্রায় ২৫ মিনিটের নিস্তব্ধতার পরে, ট্রেনের এই কামড়াতে প্রথমে ঐ উদ্ভট লোকটাই কথা বলে উঠলো। তবে আরাফাতের সাথে না, বরং ফোনে।

সহযাত্রী: আপনারা আমার কাজে চোক্ষু বুইজা বিশ্বাস করতে পারেন। আমি এই কাজে ৩০ বছর ধইরা আছি। আর “তানকিস” এর বান অনেক জোড়ালো। কাম হইবেই হইবে।

কথার ধাঁচে আরাফাতের মনে হলো লোকটা কোনো বিজনেস ডিল করছে। কিন্তু প্রোডাক্টটা কি সেটা ঠিক বুঝতে পারছেনা। যদিও তা দিয়ে আরাফাতের কোনোই কাজ নেই, তাবুও সে না চাইতেই বেশ খেয়াল করে লোকটার কথা গুলো শুনছিলো। বাড়িতে ডিশ এন্টেনা না থাকলে যেমন বিটিভি দেখলেও সময় কেটে যায়, ঠিক তেমন ভাবে ওয়ান টাইম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সহযাত্রীর ফোনালাপ শুনে সময় পার করছে আরাফাত।

সহযাত্রী: আরে না না, ঠিক হইবেনা কেনো। দেখেন, আপনারা কোরান পড়েন আমরাও পড়ি…

কথাটা বলে লোকটা একটু থামলো, থেমে চারিদিকে তাকালো, তারপর আরাফাতের দিকে তাকালো। তবে আরাফাতের মনোযোগ যে ওই লোকটার দিকে, সেটা আরাফাত লোকটাকে বুঝতে দিল না। লোকটা দেখতে পায় আরাফাত জানালার বাইরে দিনের আলো উপভোগ করায় ব্যস্ত। তাই সে ফোনে কথা চালিয়ে গেলো। তবে, এবার তার স্বরটাকে অনেক কমিয়ে ফেললো।

সহযাত্রী: আপনারাও কোরান পরেন আমরাও পড়ি, খালি আমরা একটু উল্টা পড়ি আরকি। চিন্তা কইরেন না, ঐ মাইয়া ৭ দিনের মধ্যে পাগল হইয়া আপনার কাছে ছুইটা আসবো!

বিষম খেয়ে আরাফাতের মুখ থেকে চা ফিক করে বেড়িয়ে গেলো। একি বললো এই লোক! তার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো লোকটার শেষ কথাটা, “ঐ মাইয়া ৭ দিনের মধ্যে পাগল হইয়া আপনার কাছে ছুইটা আসবো!”

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :২]

৩ বছর আগে সানার সাথে আরাফাতের ব্রেকআপ হয়। সানাই করেছে। হারাম সম্পর্কে আর থাকবেনা, যিনায় জড়াবেনা, এসব বলে। ধর্ম কর্মে মশগুল হয়ে গেছে সানা। কিন্তু আরাফাত সানাকে আজো ভালোবাসে। যদি কোনো উপায়ে তাকে ফেরত পেতে পারতো, তাহলে সে অবশ্যই সেটা করতো। জীবনে অন্য কেউ না আসলে পুরোনো মানুষটাই সব চেয়ে মূল্যবান মনে হয়। সেদিন শেষবারের মতো সানা আরাফাকে যে মেসেজটা দিয়েছিলো, তার স্মৃতি আজো আরাফাতের চোখে স্পষ্ট ভাসে।

“আমাকে মাফ করো আরাফাত, আল্লাহকে নারাজ করে আমি তোমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবোনা। দেখো, অন্য কেউ না জানুক, আমি জানি তুমি নাস্তিক। আর আমি একজন আস্তিক। দোহাই লাগে আমাকে ভুলে যাও, যে আল্লাহকে ভুলতে পারে, সে যে কাউকে ভুলতে পারবে। আর আমি আল্লাহর জন্য, যে কাউকে ভুলতে পারবো।”

এতোটুকুই ছিলো সানার শেষ কথা। তারপর থেকে সব কিছুতে তাকে ব্লক করে চিরতরে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। আরাফাত সানাকে আজো আগের মতই ভালোবাসে। তাকে সে যে কোনো রুপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তার কালো চাদরে প্যাঁচানো মোল্লা হওয়ায়ও তার কোনো আসে যায় না। কিন্তু সানা আরাফাতকে চায়না। সে কোনো ঈমানদার মুত্তাকি কে বিয়ে করতে চায়। আর আরাফাত সানার জন্য সব করতে পারলেও এটা কখনোই হতে পারবেনা। কারন সে ইসলামে বিশ্বাসই রাখেনা। এই কথাটা সানা ছাড়া অবশ্য আর কেউই এত খোলাখুলি ভাবে জানেনা। যদি আরাফাত সানা কে পাওয়ার জন্য মোল্লা সাজে, তবে তা নিতান্তই নাটক হবে। এমন জীবন আরাফাত চায়না। তাই এই দুজনের মাঝের দূরত্ব কোটি আলোকবর্ষ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রায়শই আরাফাত ভাবে, যদি কোনো উপায় হতো আবারো এক হওয়ার! আজ ট্রেনে অলৌকিক উপায়ে হারানো প্রেমিকা ফিরে পাওয়া যায় এমন বিজ্ঞপ্তি বা সোনালী সুযোগ টাইপ কিছু একটা দেখে আরাফাতের সমস্ত মনযোগ ওখানেই আটকে গেলো। তার কানে এখনও বেজেই চলেছে,

“ঐ মাইয়া ৭ দিনের মধ্যে পাগল হইয়া আপনার কাছে ছুইটা আসবো!”

অদম্য কৌতুহলে তাকিয়ে আরাফাত দাড়িওয়ালা লোকটার কথা শুনছে। “গার্লফ্রেন্ড ফেরত পাওয়া যায়” এর জায়গায় যদি “চাঁদে জমি কেনা যায়” এরকম কিছু শুনতো তাহলেও আরাফাতের এত কৌতুহল লাগত না। বেশ কিছুক্ষণ ওই লোকটার কথা খেয়াল করে শোনার পর আরাফাত বুঝে ফেলেছিল যে লোকটা কালো জাদুর কথা বলছে। আরাফাত অতিলৌকিকতায় বিশ্বাস করেনা। সেটা পজিটিভ হোক আর নেগেটিভ হোক। তবে টিনএজ বয়সে প্যারানরমাল কাহিনী পড়তে সে খুব পছন্দ করত। সেখান থেকে কালো জাদুর কথা একটু একটু মনে পড়ছে। সে জানে যে আরব, পার্সিয়ান, ইন্ডিয়ান সহ কিছু রোমানরাও ব্ল্যাক ম্যাজিকে বিশ্বাস করে। তাই সে বছরের পর বছর এটাকে তার অজ্ঞানবাদের বিশাল খাতার এক কোণে ফেলে রেখেছিল। আজ তার মনে হলো তার সামনে বসে থাকা তান্ত্রিক এর মাধ্যমে জাদুবিদ্যার সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। আর যদি সানার উপরে জাদু করাই যায়, তাহলে তো লাইলী তার মজনুর বুকে দৌড়ে চলে আসবে। আর কি চাই জীবনে!

আরাফাত: ভাই, আপনি কালো জাদু করেন?

আরাফাতের কথা শুনে লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ও আরাফাত যে তার কথা শুনছিল সেটা সে আশা করেনি। তাই সে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলো। নিজের জাদু-টোনা করার ব্যাপারটা কে ধামাচাপা দিতে চাইলো। ট্রেনের মত এরকম ভিড়ের জায়গায় নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে তান্ত্রিকের বড় ইতস্তত লাগছিল।

তান্ত্রিক: কি বলেন এসব। কালাজাদু কেন করতে যামু। আমি ঝাড়ফুঁক করি ঝাড়ফুঁক, ইসলামি ঝাড়ফুঁক।

আরাফাত: ভাই আমি কিন্তু আপনার কথা সব শুনে ফেলেছিলাম। আপনি কোরান উল্টা পড়েন তাই না?

লোকটা নাকে মুখে অস্বস্তির ছাপ। আরাফাতের কথায় সে বুঝে ফেলল যে তার সত্য ফাঁস হয়ে গেছে‌। খপ করে সে তাদের টেবিলে রাখা আরাফাতের ওয়ান টাইম চায়ের কাপটা কে হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল: যা শুনছেন ভুইলা যান!

এক মুহূর্তের জন্য আরাফাত বুঝতে পারল না যে তান্ত্রিক চায়ের কাপটাকে এভাবে হাতের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে ভরে নিল কেনো। কিন্তু পরক্ষণেই তার মাথায় আসলো, ডিএনএ! কালো জাদুর সাথে ডিএনএর একটা সম্পর্ক আছে। সেটা সে নাটক-সিনেমায় দেখেছে। তান্ত্রিককেও সে ব্যাপারে সচেতন দেখে তার কাছে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগলো।

আরাফাত: আমার চায়ের কাপ দিয়ে কি করবেন?

তান্ত্রিক: এতে আপনার মুখের লালা আছে। বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আমার জিন আপনারে শূন্যের উপরে একশো আছাড় খাওয়াইবে। বাঁচতে চাইলে আপনিও চুপ থাকেন আমিও চুপ থাকি।

আরাফাতের হাসি পেল। হাসিটা যেন পেটের মধ্যে গুর গুর করে গাল পর্যন্ত এসে আবার পেটে চলে গেলো। হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করার ইচ্ছা তার ছিলোনা। তান্ত্রিককে সে বুঝতেই দিতে চায়না যে তার কোন কথা সে বিশ্বাস করছে না।

আরাফাত: আরে না না ভাই এত ভয় পাবেন না, আমি এসব কথা কাউকে বলবো না কি, বরং আমি তো টাকা দিয়ে আমার কিছু কাজ করাতে চাচ্ছি আপনার মাধ্যমে।

আরাফাতের মনে হলো তার কথা শুনে তান্ত্রিক কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য তান্ত্রিক হাঁপিয়ে উঠেছিল। এবার কিছুটা ঠান্ডা হয়ে ওয়ান টাইম কাপটাকে নিজের পকেটের মধ্যে রেখে তান্ত্রিক আরাফাতকে জিজ্ঞেস করল,

তান্ত্রিক: কি কাজ করবার চান?

আরাফাত: একজন মানুষকে বশ করতে হবে। আমার প্রেমীকাকে। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ‌ধর্ম কর্ম পালনের জন্য। আমি শুধু তাকেই ফেরত চাই, আপনার যত টাকা লাগে আমি আপনাকে দেব। শুধু তাকে আমার কাছে সাত দিনের মধ্যে নিয়ে আসেন। ১৫ দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। সাত দিনের মধ্যে সে ফিরে আসলে, ১০ দিনে বিয়ে করে ১৫ দিনে তাকে সাথে নিয়ে শহরে ফিরবো।

তান্ত্রিক: সাত দিনের মধ্যে আনতে হলে অনেক টাকার বান মারতে হইবে। পঞ্চাশের কম না। রাজি আছেন?

আরাফাতের কোন অসন্তোষ না দেখে তান্ত্রিক একটু স্বস্তির সুরে বলল: আপনি আমার ঠিকানায় ওই মাইয়ার কোন চুল, নখ, অথবা তার গায়ের কোন কিছু একটা নিয়া আসবেন। কাম হইয়া যাইবে।

তান্ত্রিকের শেষ কথাগুলো শুনে আরাফাতের প্রচন্ড বিরক্ত লাগল। তান্ত্রিকের আস্তানায় কে যাবে! যা বোঝার সেটা সে এখানেই বুঝতে চায়।

আরাফাত: দেখেন তান্ত্রিক ভাই, আমি কোন আস্তানায় যেতে পারবো না। আপনার যা করার এখানে এখন এই মুহূর্তে করেন। আপনি বুঝতে পারছেন আমার কাছে সময় কম। লাগলে আমি আপনাকে ডাবল টাকা দেবো, আপনি এখনই জাদু করেন।

তান্ত্রিক: জাদু করতে হইলে নখ, চুল, ঘাম এইরম কিছু জিনিস লাগে কইলাম তো। আপনি কি শূন্যের উপর যাদু করতে কইতাছেন?

আরাফাত: রক্তে কাজ হবে?

তান্ত্রিক আরাফাতের প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে দুই চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল: আপনার কাছে তানার রক্ত আছে নি? রক্ত দিয়া তো সব চাইতে জলদি বান মারা যায়!

আরাফাত: জি আছে। সানা যখন অভিমান করত, তখন অনেক উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলত। একবার তো হাত কেটে তা দিয়ে আমার নাম লিখে ফেলেছিল। “আই হেইট ইউ আরাফাত”। পরের দিন রাগ ভাঙলে আবার সেই কাগজটা আমাকেই গিফট হিসেবে দেয়। সানা ভালোবাসার সবচেয়ে বড় এই প্রমাণটা কে নিয়ে আমি আজও তার স্মৃতিচারণ করি।

আরাফাত তার হ্যান্ড ব্যাগটা ঘেঁটে, তার ডাইরির ভাঁজ থেকে সানার রক্তমাখা সেই কাগজটা বের করে তান্ত্রিকের হাতে দিয়ে বলল, আপনি যত দ্রুত জাদু করবেন আপনাকে আমি ততো বেশি টাকা দেবো।

তান্ত্রিকের কাছে মনে হচ্ছে এটা খুবই লোভনীয় প্রস্তাব। কালো জাদু করা তার জন্য কোন ব্যাপার না, কিন্তু এত বড় বড় জাদুর অফার পাওয়া বড়ই কষ্ট সাধ্য। তাই সেই প্রস্তাবটা হাতছাড়া করতে চাইলোনা। কালো জাদু করার সকল সরঞ্জাম নিয়েই সে সফর করছে। যেহেতু এত হাজার টাকার ব্যাপার, সেহেতু লোক চোখের আড়ালে যেকোনো ভাবে তান্ত্রিক কাজটা সেরে ফেলতে চাচ্ছে।

তান্ত্রিক: রাত্তির গভীর হওয়ার অপেক্ষা করেন। লোকজন ঘুমান শুরু করলে আমিও জাদু শুরু কইরা দিমু। আইজই আপনার সেই মাইয়া আপনার জন্য ছটফট করতে শুরু করবে। আইজ রাইতে আপনে কিছু একটা আলামত পাইবেন। আপনার টেলিফোনের দিকে নজর রাইখেন!

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :৩]

রাত প্রায় বারোটা বাজে, ট্রেনের অধিকাংশ প্যাসেঞ্জারই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে তান্ত্রিক তার ট্রাংক থেকে কিছু পাত্র, একটা পুতুল আর কিছু সুচ বের করলো। পাত্রে পানি ঢেলে রক্ত ওয়ালা কাগজটাকে ধুয়ে তার মধ্যে কিসব মন্ত্র ফুঁকতে শুরু করলো, তারপর একটা ছোট ব্যাগ থেকে কোরানের কিছু ছেড়া পৃষ্ঠা বের করে সেগুলো নিয়ে টয়লেটে চলে গেলো।

আরাফাত অত্যন্ত কৌতূহলের সাথে তান্ত্রিকের কাজকারবার দেখছে। জাদু টোনায় বিশ্বাস না করলেও জাদু টোনা নিয়ে মুভি দেখলে যেভাবে অদ্ভুত শিহরণ হয়, তার ঠিক সেইরকম শিহরন অনুভব হচ্ছিলো। একবার যখন তান্ত্রিক টয়লেটে যায় তখন আরাফাত তান্ত্রিকের ট্রাংকটাকে কৌতূহলবশত একটু খুলে দেখে। ট্রাংকের ভিতরটা দেখে আরাফাত কিছু অস্বস্তি বোধ করলো। ওটার মধ্যে অন্তত ২০০ খানিক পুতুল হবে। প্রত্যেকটা পুতুলের গায়ে কিছু না কিছু ক্ষত করা আছে। কোন পুতুলের সাথে ৫টা, কোনোটায় ৭টা, আবার কোন পুতুলের গায়ে অগণিত পিন গাঁথা ছিলো। প্রত্যেক পুতুলের গায়ে মানুষের দেহের কোন না কোন নিশানি বাধা ছিল। কোনটার সাথে চুল বাঁধা, কোনটার সাথে নখ বাঁধা, কোনটার গায়ে আবার রক্ত লাগানো। ট্রাংকটিকে একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে না দেখতেই আরাফাত তান্ত্রিক চলে আসার শব্দ পেলো। ট্রাংকটাকে আবার বন্ধ করে নিজের জায়গায় বসে পরলো।

আরাফাত: কি ব্যাপার, বারবার টয়লেটে যাচ্ছেন যে?

তান্ত্রিক: ওদের খুশি করতে হইবো।

আরাফাত: কাদের?

তান্ত্রিক: বদ-জিনদের। কোরানের আয়াতে ময়লা লাগাইলে তারা সবচাইতে তাড়াতাড়ি খুশি হইবে। তাই জুতার নিচে কোরানের পৃষ্ঠা লাগাইয়া বাথরুমে যাইতে হইতাছে।

আরাফাতের কলিজাটা কেমন ধক করে উঠলো। মুসলিম না হলেও, নামে মুসলিম হওয়ার কারণেই হয়তো কোরআনের জুতা পায়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তার হজম করতে কষ্ট হলো। তান্ত্রিক চোখ বন্ধ করে কি সব ধ্যান করছে আর বিড়বিড় করছে। তারপর একটা মোমবাতি বের করে সেটায় আগুন ধরিয়ে কিছু একটা সুগন্ধী সে আগুনের উপরে স্থাপন করতে করতে তান্ত্রিক বললো, “ভালোবাসা বাড়াইতে সুগন্ধি দিতে হয়। বিবাহবিচ্ছেদ করতে দুর্গন্ধি দিতে হয়।”

কিছুক্ষন এই মিনিয়েচার যজ্ঞ করার পর তান্ত্রিক বললো: তারা খুশি হইছে! খুব শিজ্ঞিরি আপনার কাজে তারা লাইগা পরবে। নাজাসা বান মারসি। কঠিন বান। এখন আপনি ঘুমান। ওই মাইয়ার টেলিফোনের শব্দেই আপনার ঘুম ভাঙ্গবে। আমার এই জিন বাতাসের চেয়েও দ্রুত দৌড়ায়। এতক্ষণে পৌঁছাইয়াও গেছে।

আরাফাতের জাদু এক্সপেরিমেন্ট যতটাই আগাচ্ছে, ততটাই ফলাফল নিয়ে তার কৌতুহলও বাড়ছে। আজ সে ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে অজ্ঞানবাদের স্থান হতে হয় বিশ্বাস, না হয় অবিশ্বাসের তীরে এসে পৌঁছাবে। তাই সে যথেষ্ট কৌতূহল নিয়ে তান্ত্রিকের কথামতো ঘুমানোর চেষ্টা করল।

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :৪]

তখন রাত প্রায় ৩:৩০টা বাজে। হঠাৎ আরাফাতের ঘুম ভেঙে যায়। তবে তার কোন কল আসলো না, কোনো মেসেজও আসলোনা। আরাফাত দেখতে পেলো, তান্ত্রিক এখনও ঘুমায়নি। তাকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছিল। আরাফাত তান্ত্রিককে ডেকে বললো: কই, কল তো আসলোনা।

তান্ত্রিক: ঐ মাইয়া নাপাক না হইলে বান কাজ করবোনা। মনে হইতাছে তানি শরীর বন্ধক কইরা ঘুমায়।

আরাফাত: শরীর বন্ধক কিরকম?

কোরান সিধা পড়লে যে শক্তি পাওয়া যায়, তা কি উল্টা পড়লে পাওয়া যায়! তানি মনে হয় অজু কইরা চাইর কুল, আয়তুল কুরসী পইড়া ঘুমায়। আমার লগে যে সবচেয়ে পাওয়ারফুল জিন, ইফরিত জিন আছে, আমি তারে পাঠাইছি তানার কাছে। ফাস্ট ফাস্ট কাম করাবার জন্যে। কিন্তু আল্লার কালামের ব্যাড়াজাল ভাঙ্গা বড়ই কঠিন। আপনি ঘুমাইয়া যাওয়ার পর আমি তাকনিস, তানজিম আর আক্বসাম বান মারার ও চেষ্টা করছি। বেনা উযুতে নামাযও পড়ছি। কোনোটায় কাম হয়নাই।

কোনো কল আসতে না দেখেই আরাফাত বুঝে গিয়েছিল যে এই তান্ত্রিক ভন্ড। আয়াতুল কুরসির বেড়া, হেনতেন, সব বাহানা! উল্টা পালটা নাম বলে তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা। আসল কথা হচ্ছে ধান্দাবাজের ধান্দাবাজি শুরু হয়েছে।

আরাফাত: হয়েছে ভাই আপনার আর কিছু করতে হবে না। আপনার বান ও মারতে হবে না। আমি আপনাকে কোন টাকাও দিতে পারবোনা।

তান্ত্রিক আরাফাতের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগে ঝনঝন করে বলল: টাকা দিতে পারবেন না মানে কি? আমি তো জাদু কইরা দিছি। এখন তিনি দোয়া কালাম পইড়া ঢাল নিয়া বইসা থাকলে তাতে আমার কি দোষ! আসলে আপনি আমার জাদুতে বিশ্বাস করতেছেন না তাইনা?

আরাফাত কোন উত্তর দিল না। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ দেখে তান্ত্রিক বলল: ওই মাইয়া আপনার কাছে সাত দিনের মধ্যে অবশ্যই আসব। সেইটা দেখার জন্য আপনি নাও থাকতে পারেন।

এই বলে তান্ত্রিক তার পকেট থেকে দোমড়ানো-মোচড়ানো ওয়ান টাইম চায়ের কাপটা কে বের করে আরাফাতকে দেখিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো।

আরাফাত বুঝতে পেরেছে তান্ত্রিক তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। একটা চায়ের কাপ কারো প্রাণ নিতে পারে না এটা তার বিশ্বাস ছিল। তারপরও আবার মনের কোনায় সন্দেহের বীজ ক্ষুদ্র আকারের বাসা বুনছিল। যদি এই বানগুলো সত্যিই কাজ করে! তাহলে সানা ঠিকই আসবে, কিন্তু আরাফাত থাকবে না! সেইফটির জন্য সে ভাবলো তান্ত্রিক কে টাকাটা দিয়ে দেওয়াই ভালো। তার তো আর টাকার কমতি নেই। কিন্তু তারপর আবার ভাবে, শুধুমাত্র একটা ভয়ের কারণে টাকা দিয়ে দেবে! টাকার চেয়ে কুসংস্কারের সামনে নত হওয়াটাই তার কাছে বড় হার। ৯৯% সম্ভাবনা এই লোকটা ভন্ড। বাকি ১% সন্দেহটাকে কোন ভাবে নিজের মনের কাছে ভুল প্রমাণ করতে পারলেই এই ফ্রড লোকটাকে সে আর টাকা দিত না। এগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।

আরাফাত: আচ্ছা তান্ত্রিক মশাই, আপনি রাগ করবেন না। আমি সত্যি বলছি আপনাকে আমি ৫০ কেন, এক লাখ টাকা দেবো, আপনি শুধু বোনাস একটা কাজ করেন। ছোট্ট একটা কাজ।

তান্ত্রিক: আমিতো কইলাম মাইয়া নাপাক না হইলে বান কাজ করবো না!

আরাফাত: আরে না না ওই মেয়েকে এখন আর কিছু করতে হবে না, আমিতো আরেকজনকে জাদু করার কথা বলছিলাম। এই যে দেখেন একটা রুমাল।

আরাফাত তার ব্যাগ থেকে একটি রুমাল বের করে দিয়ে বলল: এটা আমার এক কলিগের রুমাল। সেদিন ক্যান্টিনে পরে পেয়েছি, ফেরত দিতে মনে ছিল না। ও সবসময় নাপাকই থাকে। আপনি ওর ওপরে ছোটোখাটো একটা জাদু চালান। বেশি কিছু করতে হবেনা। শালা আমার কাছ থেকে বড় টাকার ঋণ নিয়ে এখনো ফেরত দেয়নি। ওকে একটু মজা চাখাতে চাই।

তান্ত্রিক এর কাছে এটা বড় কিছু মনে হয়নি। সে ওই রুমাল টা দিয়ে আরাফাতের বন্ধুর উপরে বান মারার কাজে লেগে পড়ল। তার কাছে জানতে চাইলো যে সে কোন ধরনের বান মারতে চায়।

আরাফাত: বড় কোন বান মারবেন না। বন্ধু তো, শুধু তার বাম হাতটা কে অবশ করে দিন কিছুদিনের জন্য।

তান্ত্রিক: ঠিক আসে তাই করতাসি। আপনি আরেকবার ঘুম দিয়া উঠতে না উঠতে আপনার কাম হইয়া যাইবো!

তান্ত্রিক রুমালটা নিয়ে আরাফাতের বন্ধুর একহাত অবশ করার জন্য একটা তুলার পুতুলের বাম হাতে পিন গুঁজে দিল। তার সাথে বেঁধে দিল তার রুমাল থেকে বের করা একটা সুতা। সুতায় লেগে থাকা ঘামের গন্ধ শুঁকে জিন ওর বন্ধুর কাছে পৌঁছে যাবে। ঐদিকে আরাফাত নিশ্চিন্তে দ্বিতীয় দফা ঘুম দিল। সকালবেলা তার সব সন্দেহ দূর হবে। আর তান্ত্রিকের ধোঁকাবাজি ফাঁস হয়ে যাবে এই ভেবে।

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :৫]

২০২০, ৭ই ফেব্রুয়ারী।

“কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, থাকিতে পারিনা ঘরেতে।”

গানের এই দুই চরণ গেয়ে হাসতে হাসতে সানা আরাফাতের গায়ে ঢলে পরলো। আরাফাতও সানার রং ঢং দেখে অট্টহাসি জুড়ে দিলো।

সানা: কখনো ভাবতে পারিনি যে তোমাকেই আমি স্বামী হিসেবে পাব।

আরাফাত: আমিও ভাবতে পারিনি তোমাকে কখনো ফিরে পাবো। কখনো ভাবিনি আমাদের ভালোবাসা এইভাবে সফলতা পাবে!

এই বলে আরাফাত সানার দীঘল কালো দুই চোখের দিকে তাকায়। যে দিনটার বদৌলতে আরাফাত সানাকে পেয়েছে, সেই দিনের স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যায়।

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :৬]

সাল ২০১৭। ২০শে ডিসেম্বর।

সকাল ৬টা বাজে। ট্রেন থেমেছে আরো ৪০ মিনিট আগে। রাতভর জাদুটোনার কাজে জেগে থাকার কারণে সকালের ঘুমটা তান্ত্রিকের বড়ই মজবুত হয়। তাই ট্রেন থামার হট্টোগোল সে টেরই পেলোনা। টিকিট কাউন্টারের ডাকে যখন তার ঘুম ভাঙ্গলো, তখন চারিদিকে তাকিয়ে সে হতবাক! আরাফাত নেই, তার ট্রাংক নেই, তার জাদুটোনার কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু আছে তার কাপড়ের ব্যাগটা। বুঝতে পারল সে লুট হয়ে গেছে। তার সহযাত্রীটাই এটা করেছে। প্রতিশোধের আগুনে তান্ত্রিক পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে তার পকেটে হাত দিয়ে সেই ওয়ানটাইম চায়ের কাপটা খুঁজতে লাগলো। চায়ের কাপ টাও ছিল না, ছিল শুধু একটা চেক। ১ লাখ টাকার একটা চেক। আর তার পাশে একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিলো, “আমি নাহয় না জেনে ভুল পথে হাঁটতাম, আপনি কিভাবে জেনে বুঝে ভুল পথে হেঁটে যাচ্ছেন? ভালো হয়ে যান! আর এই টাকাটা দিয়ে কোনো একটা হালাল ব্যবসা শুরু করেন! যেই সৃষ্টিকর্তার কালাম আপনার জাদুকে হার মানিয়ে দেয়, তাঁর সাথে বিদ্রোহ করতে আপনাদের বুক কাঁপেনা?”

[ কালো জাদুর গল্প এর পেক্ষাপট :৭]

সেই রাতে তান্ত্রিকের জাদু কাজ করে গিয়েছিল। আরাফাত শুধু তান্ত্রিককে ভুল প্রমাণ করার জন্য তার নিজের রুমালটাই তান্ত্রিকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ভোর ৫ টার দিকে সে অনুভব করে, তার বাম হাতটা অবশ হয়ে গেছে। যখন সে এটা বুঝতে পারে, তখন সে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলো। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছিলো আর ফেলছিল। সে জানে তান্ত্রিকের ট্রাংকে আনুমানিক দুইশ ডামি ডল ছিলো ব্ল্যাক ম্যাজিক স্পেল করা। ট্রেন থামতেই তান্ত্রিকের ট্রাংকটাকে নিয়ে বাইরে চলে আসে। নিজের ব্যাগগুলো সে একজন ভিখারিকে দিয়ে দেয়। যাতে নিজের কোনো চিহ্নই ট্রেনে রয়ে না যায়। তার হাতে থাকে শুধু তান্ত্রিকের ট্রাংকটা। তান্ত্রিক কে তার প্রতিজ্ঞার টাকাটা ঠিকি দিয়ে যায়৷ ট্রাংকটা নিয়ে সোজা স্টেশন ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জনহীন খোলা মাঠে চলে যায়। ট্রাংকটা তালাবদ্ধ ছিলো। ইট দিয়ে তালা ভেঙ্গে ট্রাংকটাকে খুলে সেখান থেকে সবার আগে তার হাতের বান মারা পুতুলটাকে বের করল। পুতুলটার হাতে যে পিনটা ছিল সেটা খুলে ফেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার বাঁ হাতের শিরা থেকে পুনরায় রক্ত চলাচল শুরু হলো। সে দ্রুত সানার পুতুলটাকে বানমুক্ত করল। তারপর বাকি সবার পুতুল একে একে ধ্বংস করল। আস্তে আস্তে আরাফাতের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। সে কখনোই বুঝতে পারেনি জাদু এভাবে কাজ করে যাবে। তার হাতের এই বানটা সত্যি ছিলো, তার মানে জিন সত্য। কাল রাতে সানাকে যে বান মারার চেষ্টা হয়েছে সেটাও সত্য। আল্লাহর কালামের ব্যূহ সানাকে সুরক্ষিত রেখেছে সেটাও সত্য। স্বয়ং আল্লাহও সত্য!

এক টুকরো হীরা খুঁজতে গিয়ে আরাফাত হীরার খাজানা খুঁজে পেলো। নাস্তিকতা অজ্ঞানবাদের স্তরকে টপকে এক লাফে আস্তিকতা এসে পড়ল। হাটু গেড়ে বালুর মধ্যে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আরাফাত এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ – (সাঃ)

কালো জাদুর গল্প টি অন্য একটি উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। কালো জাদুর গল্প টি যার সাথে ঘটেছে তার জায়গায় আপনি হলে আপনি কি করতেন।

_________________

collected

ইসলামিক এবং অন্যান্ন বিষয়ে জানতে পারেন

জেনে নিন ইসলামে হারাম নামকরণ বা হারাম নামসমূহ

জেনে নিন ইসলামে হারাম নামকরণ বা হারাম নামসমূহ

ইসলামে উত্তম নামের গুরুত্ব: নবজাতক শিশুর নামকরণ ও করনীয়

Beef nutritional benefits and Disadvantages