১. ইসলামে নবজাতক শিশুর নামকরনের গুরুত্ব
ইসলামে নামকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোন জিনিসকেই চিহ্নিতকরণ বা শনাক্তকরণের জন্যে এর নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন : রাস্তা-ঘাট তৈরির পর এর নামকরণ করা হয়ে থাকে ভি আই পি রোেড, চিটাগাং রোড, ডি আই টি রােড, বংশাল রােড, ইত্যাদি ।
চিহ্নিতকরণ বা শনাক্তকরণই নামকরণের আসল বা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বরং ইসলামী ভাবধারা সম্বলিত নামকরণ হচ্ছে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বূপূর্ণ অংশ।
ইসলামে নামকরণ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম তাঁকে বিভিন্ন জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর সে সকল জিনিসকে ফেরেশতাগণের সম্মুখে পেশ করে তাদেরকে সেগুলোর নাম বলার জন্য বলেছিলেন ।
এ সম্পর্ক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- অর্থাৎ “তিনি (আল্লাহ) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, অতঃপর সে সমুদয় ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করে বললেন, ‘এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তােমরা সত্যবাদী হও। তাঁরা (ফেরেশতারা) বলল, ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তা ব্যতীত আমাদের তাে কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ৩১-৩২)
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন নবী-রাসুলকে তাদের আসল নাম কিংবা গুণবাচক নাম বলে ডাক দিয়েছেন। যেমন ইয়া আদাম”- ‘ইয়া মুসা’- ইয়া যাকারিয়া’-‘ইয়া ইবরাহীম’ – ইয়া মুযযাম্মিল্’ ইত্যাদি ।
পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটি সর্বপ্রথম নাযিল করা হয়েছে, সেখানেও আল্লাহ পাক নামের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলা হয়েছে পড়, তােমার প্রতিপালকের নামে- যিনি সৃষ্টি করেছেন । (সূরা আলাক, ৯৬ : ০১)
ইসলামে নবজাতক শিশুর নামকরনের গুরুত্ব ও বিধি-বিধান
অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মানুষের নামকরণেরও গুরুত্ব কম নয়। নামকরণের মূল উদ্দেশ্য যদি কেবলমাত্র শনাক্তকরণই হতো, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর পিতামাতা হয়তো সন্তানকে চিহিত বা শনাক্তকরণের জন্যে ১, ২, ৩ বা অন্য কোন সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করতেন এবং সে অংক সংখ্যা বা চিহ্ন দিয়েই সন্তানকে ডাকতেন।
সন্তানের ভাল নামকরণের জন্যে পিতামাতা পেরেশানী ভােগ করতেন না। কিন্তু দেখা যায়, সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরই তার নামকরণের জন্যে একটি ভাল নাম খুঁজতে থাকেন। ইসলামী ভাবধারা সম্বলিত নামকরণ যেমন ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অন্যদিকে নামকরণের দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মানসিকতারও উন্নতি ঘটে।
কাজেই সন্তানের নামকরণ যেমন উত্তম হতে হবে, তেমনি তা হতে হবে ইসলামী ভাবধারায় পরিপূর্ণ। যাতে নামের দ্বারাই বুঝা যায় যে, লোকটি মুসলমান।
মৃত্যুর পর ব্যক্তি তার পরিচয় সে নামেই হবে যে নামে পৃথিবীতে তাকে ডাকা হত। যদি ভাল নাম হয় তাহলে ভাল নাম, অন্যথায় খারাপ নামে ডাকা হবে।
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন
“মৃত্যুর পর ফেরেশতারা যখন রুহকে নিয়ে উধ্ব জগতে আরােহণ করে, তারা যখনই কোন ফিরিশতাদের দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন ভাল রূহের ক্ষেত্রে বলা হয়- কে এই ভাল রূহ? ফিরিশতা তার উত্তম নামের মাধ্যমে বলেন, অমুকের পুত্র অমুক। যে নামে তাকে পৃথিবীতে ডাকা হত। ।
অতপর রুহকে নিয়ে উধ্ব জগতে আরােহণ করে, তারা যখনই কোন ফিরিশতাদের দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন খারাপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ফিরিশতারা তার নিকৃষ্ট নামের মাধ্যমে বলেন- অমুকের পুত্র অমুক, যে নামে পৃথিবীতে মানুষ তাকে ডাকত।” (মুসনাদের আহমদ, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ২৮৭)
উপরােক্ত কুরআন ও হাদীসের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষের পরিচয়, শনাক্তকরণ ছাড়াও ইহকাল ও পরকালে নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২.সুন্দর নাম রাখা শিশুর নামকরনের গুরুত্ব
জন্মের পরপরই পিতামাতার ওপর কর্তব্য হলো নবজাতক শিশুর শ্রুতিমধুর, অর্থবােধক ও ইসলামসম্মত নাম রাখা। শিশুর নামকরণের একটি গুরুত্ব
রয়েছে। এতে শিশুর পরিচয়, বংশ পরিচয়, জাতীয়তা নির্ণীত হয়।
কিয়ামতের দিন প্রত্যেককে তার নাম ধরে ডাকা হবে। মহানবী (সা.) বলেন, “আবু দারদা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন : “নিশ্চয় কিয়ামতের দিন তােমাদেরকে তােমাদের পিতাদের নামসহ ডাকা হবে। সুতরাং তােমরা তােমাদের সুন্দর নাম রাখবে”-(ইমাম আবু দাউদ, সুনান আবু দাউস, হাদীস নং ৪৯৪৮।)
পৃথিবীর সব সমাজেই এ প্রথা প্রচলিত। ইসলামে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এ নামের প্রভাবে শিশুর পরবর্তী জীবনে স্বভাব-চরিত্রে শুচি-শুভ্রতা
ফুটে ওঠে। পরিচয়ের জন্য নামকরণ শিশুর জন্মগত অধিকার। এতে শিশুর বংশপরিচয় অনেকগুলা মৌলিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
হাদীসে এজন্য নবজাতক শিশুর নামকরণের বিষয়টি অতীব গুরুত্বেরে সাথে বিধৃত হয়েছে। নিন্মোক্ত আয়াত কয়টি এ ব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য: “হে মানবজাতি! আমি তােমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি । এ ওপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীভূত করেছি যাতে তােমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার । অবশ্য আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীয় সে ব্যক্তি যে তােমাদের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়বান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ ,সর্বজান্তা”(আল কুরআন সূরা হুজুরাত ৪৯ :১৯)
নাম রাখার ক্ষেত্রে নামের অর্থ, প্রয়োজন, বিধি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ রাখা একান্ত প্রয়োজন। অসাবধানতা ও অভজ্ঞতাবশত কোন অর্থহীন বা বিদঘুটে নাম রেখে ফেললে তা পরিবর্তন করে একটি সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা অবশ্য কর্তব্য।
আর এজন্য রাসূল সা. কোন সময় কারো নাম খারাপ পেলে তার নাম সাথে সাথে পরিবর্তন করে দিতেন । এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় হযরত “আয়িশা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল এ কারও মন্দ নাম পেলে তা পরিবর্তন করে দিতেন” ।(ইমাম তিরমিজি, জামিউত তিরমিযী, হাদীস নং : ২৮৩৯।)
ইউরোপ যাওয়ার উপায় জানতে চান
৩. সুন্দর নামের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য অপরিসীম
সন্তানের প্রতি পিতা মাতার দায়িত্ব হলাে তাদের সুন্দর ও ইসলাম সম্মত নাম রাখা। নবী করিম এরশাদ করেছেন- “তােমরা আমার নামে নাম রাখাে তবে, আমার উপনামে তােমরা নাম রেখা না”
সন্তানের সুন্দর নাম রাখা, তাদের আদব কায়দা শিক্ষা দেওয়া পিতা মাতার ওপর একটা বড় দায়িত্ব। আজবকাল আমাদের মুসলিম সমাজের সন্তানদের
নামকরণে আমরা অত্যন্ত উদাসীন ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়ে থাকি । আমাদের সস্তানদের নাম শুনে মনে হয় না যে সে হিন্দু না মুসলমান । ছেলে না মেয়ে ইনসান না অন্য কোন জাতি।
এমনকি আমরা আল্লাহ শব্দেরও প্রতিশব্দ বের গরে ফেলেছি। আমরা আল্লাহকে খােদা বলে ডাকি। আল্লাহ নামের প্রতিশব্দ খােদা নয়। পৃথিবীর কোন ভাষার কোন শব্দই এ অদ্বিতীয় শব্দের প্রতিশব্দ হওয়ার স্পর্ধা রাখে না।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কোথাও আল্লাহ শব্দের কোন প্রতিশব্দ নাই। মহান আল্লাহ যেমন অদ্বিতীয়, তার জাত পাক এ মহা মহিমান্বিত নামও তেমনি অদ্বিতীয়, অনুপম। হযরত আবু হুরায়রা হতে বণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন “নিঃসন্দেহ মহান আল্লাহর নিরানব্বই অর্থাৎ এক কম একশতটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এ সকল নাম মুখস্থ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
কুরআরে শিশুর নামকরনের গুরুত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
“তােমরা সে সমস্ত নামের দ্বারা তাকে ডাকো, আর যারা তার নামের মাহাত্যকে অস্বীকার করে, সে সমস্ত পাপাচারীদের কর্মপদ্ধতি ত্যাগ কর। অচিরেই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি দেওয়া হবে”
সূরা বনী ইসরাঈলের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বল তােমরা আল্লাহ নামে আহবান কর বা রহমান নামে আহবান কর, তোমরা যে নামেই আহবান কর সকল সুন্দর নামই তো তার।” আমাদের উচিত উপযুক্ত পাত্রে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করা। যদি আমরা না করি তাহলে সেটা হবে জুলুম।
পিতা মাতা কে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিটি শিশুরই একটা সুন্দর নাম, উত্তম চরিত্র এবং মানসম্মত শিক্ষা লাভের অধিকার আছে । হযরত সামুরা ইবনে জনদুব বলেন- রাসূল বলেছেন, “জন্মের সপ্তম দিন তার (শিশুর) পক্ষ থেকে পশু জবেহ করবে, নাম রাখবে ও তার মাথা মুণ্ডন করবে”
শিশুদের নাম রাখতে হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের নামের সাথে সম্পর্ক রেখে। সুতরাং শিশুর জীবনের Turning point শুরু হয় ভালো নাম রাখার মধ্য দিয়ে। আর নাম রাখার ব্যাপারে আমরা যােগ্য আলেমদের সহযোগিতা নিতে পারি । রাসূল বলেন- “আল্লাহ তায়ালার নিকট কেয়ামতের দিন সে ব্যক্তির সবচেয়ে ঘৃণিত যে তার নাম ধারণ করেছে “রাজাধিরাজ।“
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, রাসূল বলেছেন- “তােমাদের নামসমূহের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হলাে আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান (মুসলিম) । নবী বলেন, রাসূল। বলেছেন- “। নবী বলেন- “মুমিনের হক অপর মুমিনের ওপর এই যে, তাকে অধিক পছন্দনীয় নাম ও পদবী সহকারে ডাকবে ।” শিশুর জন্য সুন্দর নাম রাখা ও সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা মাতার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
৪. নাম সরকারের রেজিস্ট্রিভুক্তকরণ/নাম নিবন্ধন
শুধু সন্তানের নাম রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে তা নয়। বরং ইসলামই বিশ্বায়নের এ যুগে এসে জাতিসংঘও এ ব্যাপারে সক্রিয়। তাই জাতিসংঘ ঘােষিত শিশু অধিকার সনদে ৭ নং ধারায় বলা হয়েছে-
(১) জন্মের অব্যবহিতে পরেই সস্তানের নিবন্ধীকরণ করতে হবে এবং জন্ম থেকেই তার নামকরণ লাভের একটি জাতীয়তা অর্জনের এবং যতটা সম্ভব পিতামাতার পরিচয় জানার ও তাদের হাতে প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার থাকবে।
(২) শরীক রাষ্ট্রসমূহ তাদের জাতীয় আইন অনুসারে এ অধিকারসমূহের বান্তবায়ন নিশ্চিত করবে এবং এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সে সব আন্তর্জাতিক দলীলসমূহের বাধ্যবাধকতা মেনে চলবে। বিশেষ করে সে সব ক্ষেত্রে যেখানে এর অন্যথায় শিশু রাষ্টহীন হয়ে যাবে।
সনদ অনুযায়ী সন্তানের সুরক্ষার অধিকারের জন্য সার্বজনীন জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে সন্তানের সঠিক বয়স সম্পর্কে ধারণা রাখা অপরিহায্য।
৫. নবজাতক শিশুর নাম কে রাখবে
ইবনে আরফা উল্লেখ করেছেন, নামকরণের ক্ষেত্রে মাতার তুলনায় পিতা অগ্রগণ্য। যদি পিতা-মাতা নামকরণে মতভেদ করেন তবে পিতা অগ্রাধিকার পাবে। তবে অন্য কারো রাখা নাম পিতা-মাতার সম্মতিতে রাখা যাবে।
আমাদের দেশে শিশুর জন্মের পর নাম রাখা নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা দেখা যায়। দাদা এক নাম রাখলে নানা অন্য একটা নাম পছন্দ করেন। বাবা-মা শিশুকে এক নামে ডাকে। খালারা বা ফুফুরা আবার ভিন্ন নামে ডাকে। এভাবে একটা বিড়ম্বনা প্রায়শঃ দেখা যায়।
শিশুর পিতার অনুমোদন সাপেক্ষে আত্মীয়স্বরজন বা অপর কোনো ব্যক্তি শিশুর নাম রাখতে পারেন। তবে যে নামটি শিশুর জন্য পছন্দ করা হয় সে নামে শিশুকে ডাকা উচিত। অর বিরোধ দেখা দিলে পিতাই পাবেন অগ্রাধিকার ।
কুরআনে আল্লাহ বলেন “তোমরা তাদেরকে তাদের পিতার পরিচয়ে ডাক এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত”(সূরা আহযাব ৩৩:৫)
অতএব শিশুর নামকরনের গুরুত্ব সহ কারে বিবেচনা করতে হবে। এবং শিশুর নামকরনের গুরুত্ব দায়িত্ব সহকারে পালন করতে হবে।
নবজাতক শিশুর প্রতি করণীয় বিষয়াদি : পর্ব-৩